হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধ হলে সবার জন্যই মঙ্গল
আবু রায়হান (বর্ষন)
হলুদ সাংবাদিকতার ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও এটি সাংবাদিকতার মহান পেশাকে কলুষিত করে। সেই সাথে সমাজের মানুষকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দেয়। এমনকি সামাজিক অপরাধ জগতেও জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার এমনও শোনা যায় অপরাধ জগত থেকে বেরিয়ে এসে কলঙ্ক ঢাকার জন্য কেউ কেউ এ পেশায় এসে হলুদ সাংবাদিকতা চর্চা করে। যারা হলুদ সাংবাদিকতা চর্চা করে তারা প্রকৃত সাংবাদিক নয়, তাদের এ পেশা থেকে দুরে থাকা উচিৎ। হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধ হলে সবার জন্যই মঙ্গল। কারণ সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র হচ্ছে বৃদ্ধিবৃত্তি চর্চার এক পবিত্র শিা কেন্দ্র। যেখান থেকে যে কেউ এ পেশাকে সমাজের কল্যাণের জন্য বেছে নিতে পারেন।এখানে উল্লেখ করা যায়, সাংবাদিকতায় কর্মদতা অর্জনের জন্য অবশ্যই অনুশীলন করতে হবে। অনুশীলন হচ্ছে জ্ঞানের উৎস। একজন সাংবাদিক কিভাবে লোক সমাজে নিজেকে উপস্থাপন করবেন তার উপরও শিা ও রুচি জ্ঞান থাকার দরকার। পোশাক, ভাষাজ্ঞান, আচার, ব্যাবহার এসবই একজন সাংবাদিকের মর্যাদার মাপকাঠিতে বিবেচিত হয় লোকসমাজে। আমাদের দেশে বহু গুনি সাংবাদিকের জন্ম হয়েছে। তাদের জীবন থেকে একজন তরুণ সাংবাদিকের শিা নেওয়া দরকার।বর্তমান বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ও উৎকর্ষের সুবাদে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানব সভ্যতার দৃশ্যপট। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারণা ও কৌশলগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। একুশ শতকের আগে সংবাদপত্র কেন্দ্রিক রিপোর্টিং কাজ ছিল মূখ্য প্রবণতা। সেই রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়েই এ পর্যন্ত এসেছে। সাম্প্রতিককালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রিপোর্টিং করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিগত সময় রিপোর্টিং এর জন্য কাগজ, কলম, নোটবুক, আর ম্যানুয়াল ক্যামেরা নির্ভর ছিল।
এখন তা বদলে দিয়েছে ল্যাপটপ কম্পিউটার, ডিজিটাল ক্যামেরা, এমনকি মোবাইল ফোন ও মাল্টিমিডিয়া নির্ভর যন্ত্রকৌশল। আর ওয়াল্ড ওয়াইড ওয়েবে’র অনলাইন নিউজ পেপার, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এর ব্যাপক বিস্তার। এখানে সাংবাদিকতার পেশায় অবশ্যই শিা-জ্ঞান ও দতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই সাংবাদিকতার পেশাকে মানসম্মত করা যাবে না। এর জন্য ব্যবহারিক শিা প্রয়োজন।একজন সাংবাদিক ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম অর্থাৎ পৃথিবীর এবং পৃথিবীর বাইরের জানা অজানা সবরকম তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ ও তার সংবাদ প্রকাশ করে থাকে কল্যাণের জন্য। সাংবাদিকতা কোন গন্ডির মধ্যে সীমাব্ধ নয়। এমকি কোন বিশেষ ক্ষেত্রের জন্যও নয়। সাংবাদিকতা হচ্ছে সার্বজনিন। একজন প্রকৃত সাংবাদিকের পরিচয় তার লিখনিতে। কল্যাণকর যে কোন বিষয়ের উপর একজন সাংবাদিক বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশন করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রের তিকর কোন তথ্য সম্বলিত সংবাদ পরিবেশন এবং তা প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতিমালা বহির্ভূত এবং দণ্ডনীয় অপরাধও বটে। তিকর ও কল্যাণকর দু’টি শব্দ মাথায় রেখে একজন সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব পালন করা বাঞ্চনীয়।
এখানে হলুদ সাংবাদিকতার কোন অস্তিত্ব নেই। হলুদ সাংবাদিকতাও এক ধরনের বড় অপরাধ যা আইনের আওতায় পড়লে শাস্তি হতে পারে। হলুদ সাংবাদিকতার চারিত্রিক গুণাবলী ও কুফল ঃ এক কথায় ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তিকর। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভয়-ভীতি সৃষ্টি, অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন, সমাজের উপর হীন প্রভাব বিস্তার যা সত্যিকার সাংবাদিকতার পেশাকে কলুশিত করে।
এমনও দেখা যায় একজন ব্যাক্তি সামাজিক অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে সাজা পাওয়ার পর মুক্তি পেয়ে সমাজে যখন গ্রহণযোগ্যতা হারায় তখন পূর্বের পরিচিতি ঢাকতে এবং অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেয়। আবার সাংবাদিকতার পেশার অন্তরালে পুলিশ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদকের ব্যবসা, কালোবাজারি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কালো টাকা উপার্জনের প্রবণতার কথা অস্বীকার করা যায় না।দেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকায় সুযোগ না পেলেও অনিয়মিত পত্রিকায় এমনকি যে পত্রিকার নামও কেউ জানে না এমন পত্রিকার কর্তৃপ মহোদয়ের নিকট থেকে একটা সংবাদদাতা বা প্রতিনিধির পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সাংবাদিক বনে যায়। আবার জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে নিজেকে ভাবতে শুরু করে কত বড় একজন সাংবাদিক হয়ে গেলাম এখন আর ঠেকায় কে? তখন সে পরিচয় পত্র পকেটে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের বিত্তবানদের কাছে পরিচয় পত্র দেখিয়ে নানা বাহানায় সংবাদ প্রকাশের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে টাকা আদায় শুরু করে। এমন অনেক সহজ সরল মানুষ ওই সাংবাদিকের প্রতারণা না বুঝতে পেড়ে মান-সম্মানের ভয়ে এবং ঝামেলা এড়ানোর জন্য টাকা দিতে বাধ্য হয়। আবার কোন কোন পত্রিকার মালিক সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে হলুদ সাংবাদিকতায় সহযোগিতা করে তাদের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে থাকে, এমন তথ্যও পাওয়া যায়। অর্থাৎ হলুদ সাংবাদিকতা সম্পর্কে এখন আর না বোঝার কারণ নেই।একজন মানি লোকের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক তথ্য পরিবেশন করে মান হানী করা, সরকারের উন্নয়ন কাজকে নেতিবাক ভাবে তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাকে বিপাকে ফেলাসহ অপসাংবাদিকতার সংস্কৃতি ক্রমেই শক্তিশালি হচ্ছে। সরকারের সংশিষ্ট বিভাগের এমন অনেক কর্মকর্তা জানান, ওইসব ব্যক্তি সাংবাদিক পরিচয়ে এসে প্রথম বাক্যটি উচ্চারণ করে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আপনি এ দপ্তরে দায়িত্বে থেকে দুর্নীতি করছেন। আপনার বিরুদ্ধে আমি সংবাদ পরিবেশন করবো। সংবাদ প্রকাশ হলে আপনার চাকরি চলে যাবে। তখন ওই কর্মকর্তা জানতে চান তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো কী ? এ প্রশ্নে উত্তরে সাংবাদিক ব্যক্তি কোন অভিযোগের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়ে তর্কে জড়িয়ে পরে। এক পর্যায়ে গাড়ি ভাড়া বাবদ কিছু টাকা দাবী করে বসে। এধরনের সাংবাদিকের মধ্যে দু’একজন মেয়েদেরও দেখা যায়।
ওই সকল কর্মকর্তা এমন অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সত্যিকার একজন সাংবাদিকের আচরণ এরকম হতে পারে না। সাংবাদিকগণ সরকারি অফিসে আসেন উন্নয়ন কাজের অথবা কোন অনিয়ম হলে তার তথ্য সংগ্রহের জন্য নিজেদের সম্মানের প্রতি খেয়াল রেখে। তারা সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। অনেক সময় আপ্যয়ন করতে চাইলে তা গ্রহণ করেন না। এর বাইরে যারা সাংবাদিক পরিচয় দেয় তারা কোন ধরণের সাংবাদিক জানতে চান ওই সরকারি কর্মকর্তা।
ব্যবসায়ী মহল জানায়, কিছু সংখ্যক সাংবাদিক মাছের বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রেতাকে ফরমালিন মেশানো মাছ বিক্রির অভিযোগ খাড়া করে ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় অথবা মাছ নেওয়া, ভেজাল তেল বিক্রির অভিযোগ খাড়া করে তেল বিক্রেতার কাছ থেকে উৎকোচ আদায়। এছাড়াও গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনাকে হত্যা বলে পুলিশের ভয় দেখিয়ে স্বামীর নিকট থেকে টাকা আদায় করার মতো অনেক তথ্য পাওয়া যায় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। এধরনের অনেক ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়, যার বর্ণনা করে শেষ করার উপায় নেই। হলুদ সাংবাদিকের কাজই হলো টাকা উপার্জনের জন্য মানুষের দোষ খোঁজা, ভাল দিকগুলো নয়। এ ধরণের সাংবাদিকতা বন্ধ করা দরকার। এ জন্য প্রথমে সংবাদ পত্রের কর্তৃপকে সজাগ হওয়া, প্রকৃত সংবাদ কর্মীদের সম্মিলিত ভাবে প্রতিবাদ করা, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বিভাগের আইনী পদপে গ্রহণ করা। হলুদ সাংবাদিকতাকে বন্ধ করা না গেলে এর ব্যাপক বিস্তার ঘটলে সত্যিকার সাংবাদিকদের লোক সমাজে পরিচয় দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সমাজও আক্রান্ত হবে, সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে।
No comments